প্রত্যয় নিউজ ডেস্ক: ‘বন্দরবাজার পুলিশ ফাঁড়িতে নির্যাতনের পর রায়হানের পরনের শার্ট-প্যান্ট পাল্টে দেয়া হয়েছিল। মর্গে আমার ছেলের পরনে যে শার্ট-প্যান্ট ছিল সেগুলো তার না। মর্গে ছেলের লাশ দেখে এই ব্যাপারটি আমিই প্রথম চিৎকার করে বলেছিলাম। শার্ট-প্যান্ট বদল করে হয়তো ছেলেটারে পরিকল্পিতভাবে বেওয়ারিশ লাশ বানাতে চেয়েছিল পুলিশ। কিন্তু পুলিশ সদস্য তৌহিদের মোবাইল থেকে কল করে তাকে বন্দরবাজার ফাঁড়িতে নির্যাতন করা হচ্ছে জানানোয় পুলিশের সেই পরিকল্পনা ভেস্তে যায়। আর তাকে নির্যাতন করে হত্যার বিষয়ও প্রমাণিত হয় এক মোবাইল কল থেকেই।’
সিলেট নগরের বন্দরবাজার পুলিশ ফাঁড়িতে গত ১১ অক্টোবর পুলিশের নির্যাতনে মারা যাওয়া যুবক রায়হান আহমদের মা সালমা বেগমেরর সঙ্গে আলাপকালে কান্নাজড়িত কণ্ঠে এসব কথা বলেন।
তিনি জানান, রায়হান ঘটনার দিন বাদ আসর বাসা থেকে বের হওয়ার সময় তার পরনে নেভি ব্লু শার্ট ও প্যান্ট ছিল। কিন্তু এমএজি ওসমানী মেডিকেল কলেজের মর্গে রায়হানের পরনে যে মেরুন রঙের ডোরাকাটা শার্ট ও অর্ধেক কাটা প্যান্ট পাওয়া যায় এ ধরনের পোশাক তার ছিলই না। আলামত হিসেবে ওই কাপড়গুলো তিনি রেখে দিয়েছেন।
রায়হানের মা সালমা বেগম বলেন, শুধুমাত্র ১০ হাজার টাকার জন্য আমার ছেলেটারে মেরে ফেলেছে পুলিশ। এটা আমি বিশ্বাস করি না। রায়হানকে হত্যার পেছনে অন্য বড় কোনো কারণ থাকতে পারে। নইলে এভাবে কেউ মারে? কী কষ্ট দিয়ে মারা হয়েছে আমার কলিজার টুকরোটারে। ১১১টা আঘাত করা হয়েছে ওর ছোট শরীরটায়। না জানি কী কষ্ট পেয়েছে আমার পুতে (ছেলে)। আমি তো মা, কী করে সহ্য করব, আমি তো ভাবতেই পারছি না আমার রায়হান আর নেই। সে আমেরিকায় যাওয়ার সব কাজ করা ছিল। শুধু করোনার জন্য যেতে পারেনি। যদি আমেরিকা চলে যেত তাহলে হইতো এমন বিভৎস দৃশ্য আমার দেখতে হতো না।
তিনি বলেন, শুধু এসআই আকবর নয়, এ ঘটনার সঙ্গে হইতো আরও অনেকে জড়িত আছে। আকবরকে গ্রেফতার করে রিমান্ডে নিলে সব জানা যেত।
আকবরসহ কয়েকজন অভিযুক্ত শনাক্ত হওয়ার পরও গ্রেফতার না হওয়ায় ক্ষোভ প্রকাশ করে সালমা বেগম বলেন, এই ক্ষোভ কেবল আমার নয়, এই ক্ষোভ দেশের সকল শান্তি প্রিয় মানুষের। আজ যদি পুলিশ না হয়ে কোনো সাধারণ মানুষের বিরুদ্ধে এ অভিযোগ থাকত, তাহলে কি গাফিলতি করতে পারত পুলিশ? গণদাবির মুখে আসামিকে দ্রুত গ্রেফতার করতেই তো পুলিশকে আমরা দেখি। এখন পুলিশের কাছ থেকে পুলিশের অপরাধের বিচার পাব না? আমার ছেলে হত্যার বিচারের নিশ্চয়তা চাই।
রায়হানের দাদা একজন পুলিশ সদস্য ছিলেন। তার বাবাও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর (বিডিআর) একজন সদস্য ছিলেন। অথচ পুলিশের পরিবারের সদস্যকেই আজ পুলিশি নির্যাতনে মরতে হলো।
সালমা বেগম বলেন, রায়হানকে সাত মাসের গর্ভে রেখে তার বাবা মাত্র ৩৫ বছর বয়সে দূরারোগ্য ব্যধিতে মারা যান। তখন তিনি বিডিআরের ২৯ ব্যাটালিয়নের একজন হাবিলদার ছিলেন। ছেলেটা জন্ম নিয়ে তার বাবার মুখ দেখেনি। আজ একই বয়সে রায়হানও পুলিশের নির্যাতনে অকালে মারা গেল আড়াই মাসের একটা কন্যা সন্তান রেখে। তার সন্তানের বাবা ডাকটাও সে শুনতে পারলো না। আমি এত কষ্ট কোথায় রাখব?
তিনি বলেন, মাননীয় প্রধানমন্ত্রীও একজন মা। তার কাছে আমার আবদার, আমার রায়হানের মধ্য দিয়ে যেন চিরতরে বন্ধ হয় বাংলাদেশে পুলিশের হেফাজতে সব নির্যাতন-হত্যা। কোনো মাকে যেন আমার মতো ছেলে হত্যার বিচার আর চাইতে না হয়।
তিনি বলেন, ফাঁড়িতেই যখন ঘটনা ঘটেছে, তখন তো কোনো পাবলিক জড়িত না। সবাই ফাঁড়ির পুলিশ। তাদের কয়েকজনকে আমি মর্গে দেখে গালিও দিয়েছি। বলেছি, আমার ছেলের পরনে এই শার্ট-প্যান্ট বদল করে লাশটা বেওয়ারিশ বানানোর চেষ্টা করা হয়েছে। এগুলো আমি রেখে দিয়েছি। তদন্ত করলে এখান থেকে অনেক কিছু বের হতে পারে।
হত্যার পর ঘটনা ধামাচাপা দিতে রায়হানকে ছিনতাইকারী দাবি করে পুলিশ অপপ্রচার চালিয়েছে দাবি করে সালমা বেগম বলেন, পুলিশ ঘটনা ধামাচাপা দিতে এসব মিথ্যা বলেছে। পুলিশকে আমরা রক্ষক বলি। রক্ষকেরাই ভক্ষক হয় তাহলে আমরা আজ আর কাছ যাবো।
পুলিশ ফাঁড়ি থেকে আসা ফোন, মানুষের প্রতিবাদ, সাংবাদিক ভাইদের ভূমিকার কারণে পুলিশের অপপ্রচার কাজে আসেনি বরং সত্য প্রকাশিত হয়েছে। নইলে তো আমার ছেলেকে আজ ছিনতাইকারী বানিয়ে আমাদের মানসম্মান সব তারা ধুলোয় মিশিয়ে দিতো।
উল্লেখ্য, গত ১০ অক্টোবর দিবাগত রাতে সিলেট মহানগর পুলিশের কোতোয়ালি থানাধীন বন্দরবাজার পুলিশ ফাঁড়িতে পুলিশের নির্যাতনের শিকার হন রায়হান আহমদ। পরদিন সকালে সিলেট এমএজি ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে তিনি মারা যান। রায়হান সিলেট নগরের আখালিয়ার নেহারিপাড়ার মৃত রফিকুল ইসলামের ছেলে। নগরের রিকাবিবাজার স্টেডিয়াম মার্কেটে এক চিকিৎসকের চেম্বারে চাকরি করতেন।
এ ঘটনায় ১২ অক্টোবর রাত আড়াইটার দিকে অজ্ঞাতনামাদের আসামি করে হেফাজতে মৃত্যু আইনে সিলেট কোতোয়ালি মডেল থানায় মামলা করেন রায়হানের স্ত্রী তাহমিনা আক্তার তান্নি।
এরপর পুলিশের পক্ষ থেকে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হলে রায়হানকে ফাঁড়িতে এনে নির্যাতনের প্রাথমিক প্রমাণ পায় কমিটি। এই তদন্ত কমিটির সুপারিশে বন্দরবাজার ফাঁড়ির ইনচার্জ এসআই আকবর হোসেন ভূইয়া, কনস্টেবল হারুনুর রশিদ, তৌহিদ মিয়া ও টিটুচন্দ্র দাসকে সাময়িক বরখাস্ত এবং এএসআই আশেক এলাহী, এএসআই কুতুব আলী ও কনস্টেবল সজিব হোসেনকে প্রত্যাহার করা হয়। ১৪ অক্টোবর পুলিশ সদর দফতরের নির্দেশে মামলার তদন্তের দায়িত্ব পায় পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই)।
এ মামলায় গত ২০ অক্টোবর পুলিশ কনস্টেবল টিটু চন্দ্র দাসকে গ্রেফতার করে পাঁচদিনের রিমান্ডে নিয়েছে পিবিআই। হত্যাকাণ্ডের ১২ দিন হতে চললেও এখনও আর কোনো আসামিকে গ্রেফতার করতে পারেনি আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী।
এ ঘটনার প্রতিবাদে আন্দোলনে নামে সিলেটের বিভিন্ন শ্রেণিপেশার মানুষ। এরপর সিলেট মহানগর পুলিশকে নিয়ে সমালোচনার সৃষ্টি হয়। এই সমালোচনার মুখে গত ২২ অক্টোবর সিলেট মহানগর পুলিশের কমিশনার গোলাম কিবরিয়াকে বদলি করা হয়। তিনি সিলেটে দীর্ঘ সাড়ে চার বছর ধরে থাকায় এখানকার দুর্নীতিবাজ পুলিশ সদস্যদের সঙ্গে তার সখ্যতা গড়ে ওঠারও অভিযোগ রয়েছে।